(তথ্যসূত্রঃ মানাক্বিবুল ইমাম আবু হানিফা লিল- মাক্কী-১৪৩, উসূলুদ্দীন ইনদাল ইমাম আবি হানীফা-১/১৪৯, স্মরণ ও সান্নিধ্য: আল্লামা হাশেমীর নোটখাতা)
ইমাম আযম আবু হানিফা (রা.) সত্যিকারের আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অনুসারী এবং আওলাদে রাসূলের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা পোষণকারী মহান ব্যক্তি। ইমাম আযম আবু হানিফা (রা.) যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, তিনি যুক্তির উপর
হাদীসে রাসূলকে প্রাধান্য দেন।
আহলে হাদীস(!) নামক সালাফীরা যে ইমাম আযম আবু হানিফা (রা.) এর বিরুদ্ধে হাদীস না মানার মিথ্যা অভিযোগ করে উল্লেখিত ঘটনাটি তাদের দাঁতভাঙ্গা জবাব। ইমাম আবু
হানিফা (রা.) আওলাদে রাসূল কর্তৃক চুমু খাওয়ার সৌভাগ্যবান ব্যক্তি।
পরিশেষে কোরআন-হাদীসের বাইরে কিছু মানেনা দাবীদার সালাফী তথা লা-মাযহাবী বন্ধুদের প্রতি প্রখ্যাত তাবেয়ী ও মুহাদ্দিস হযরত সুলাইমান আমশ এর একটি উক্তি, দু’টি প্রশ্ন ও
একটি অনুরোধ রেখে প্রথম পর্বের আলোচনা শেষ করতে চাই।
প্রখ্যাত তাবেয়ী ও মুহাদ্দিস হযরত সুলাইমান আমশ তায়েবী কয়েকশ মুহাদ্দিস ও ফকিহ'র উপস্থিতিতে ইমাম আবু হানিফাকে বলেছিলেন, হে ফকিহ সম্প্রদায়! আপনারা হচ্ছেন ডাক্তার আর আমরা হলাম ওষুধ বিক্রেতা।
প্রশ্ন দু’টি হলঃ
(ক) হাদীস শরীফে পানির জাহাজ তথা যে কোন জলযান ও
প্রাণীর উপর সওয়ারীদের কিভাবে নামাজ পড়তে হবে তার বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু উড়ো জাহাজে কিভাবে নামাজ পড়বেন তার সমাধান কিভাবে দেবেন?
(খ) হাদীস শরীফে যেকোন প্রক্রিয়াজাত চামড়াকে পবিত্র বলা
হয়েছে। আমার সালাফী বন্ধুরা কুকুর, শুকুর, বাঘ ও শিয়ালের চামড়া প্রক্রিয়াজাত করলে তাকে কি বৈধ বলবেন?
সালাফী বন্ধুদের প্রতি অনুরোধ, কোরআন হাদীস ছাড়া কিছু
মানিনা, বুঝি না বলে মাযহাবের ইমাম ও মুজতাহিদগণের কোরআন হাদীসের আলোকে ইজমা কিয়াসের মাধ্যমে পরিবর্তিত বিশ্বের সাথে সমন্বয় বজায় রেখে উত্তম পন্থা
উদ্ভাবনের পথ রুদ্ধের অপচেষ্টা চালাবেন না। বলার অপেক্ষা রাখে না সর্বকালের সর্বযুগের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ ও সার্বজনীন ধর্ম ইসলাম সব সময় মধ্যপন্থা কেই পছন্দ করে। কোন প্রকার
উগ্রতা ও জঙ্গিবাদের স্থান ইসলামে নেই।
★ঐতিহাসিক সাক্ষাৎ ইমাম জাফর সাদেকের (রা.) সাথে:
বিখ্যাত মুহাদ্দিস হযরত ইবনু আবি ইয়ালা (রহ.) বর্ণনা করেন, আমি এবং আবু হানীফা (রা.) একদিন আওলাদে রাসূল (দ.) হযরত ইমাম জা’ফর সাদেক (রা.) (যিনি হচ্ছেন ইমাম বাকের (রা.) এর ছেলে) এর দরবারে গেলাম।
তিনি আমার সাথে কে জিজ্ঞেস করলে আমি উত্তরে বললাম, তিনি হচ্ছেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও দ্বীনের বিষয়ে পন্ডিতজন ব্যক্তি।
শুনে তিনি বললেন, তিনি দ্বীনের বিষয়কে যুক্তি দিয়ে যাচাই করেন?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
তখন তিনি আবু হানিফাকে বললেন, আপনার নাম কি?
তিনি বললেন, নু’মান।
শুনে ইমাম জা’ফর সাদেক (রা.) বললেন, মস্তককে যুক্তি দিয়ে মাপার কী আছে?
তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, তুমি কি জান চোখের পানিতে লবণাক্ততা কেন?
কর্ণের মধ্যে তিক্ততা কেন?
নাকের মধ্যে গরম কেন?
জিহ্বায় মিষ্টি কেন?
ইমাম আবু হানিফা (রা.) বললেন, এর কারণ তো আমার জানা নেই।
ইমাম জাফর সাদেক (রা.) বললেন, তুমি এমন কোন বাক্য সম্পর্কে জান, যেটার প্রথম অংশ মানুষকে নাস্তিক তথা কাফের
বানায় আর অপর অংশ মু’মিন বা বিশ্বাসী বানায়?
তিনি বলেন, আমি তো জানিনা।
অতঃপর ইমাম জাফর সাদেক রাদ্বিয়াল্লাহ তা’য়ালা আনহু
বললেন, কোনটা বড় অপরাধ- যেনা, নাকি খুন?
ইমাম আবু হানিফা (রা.) বললেন, আমার তো মনে হয় খুন করা বড় অপরাধ।
ইমাম জা’ফর সাদেক (রা.) বললেন, তাহলে আহকামুল হাকেমীন আল্লাহর হেকমত কি? বড় অপরাধ হওয়া সত্ত্বেও খুনের ক্ষেত্রে দুইজন সাক্ষীই যথেষ্ট আর তুলনামূলকভাবে কম অপরাধ হওয়া সত্ত্বেও যেনার ক্ষেত্রে চারজন সাক্ষীর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন কেন? এই ক্ষেত্রে তোমার যুক্তিটা কি?
ইমাম আবু হানীফা (রা.) বললেন, আমি তো জানি না।
অতঃপর বললেন, বলতো কোনটি বেশী গুরুত্বপূর্ণ? নামায নাকি
রোযা?
তিনি বললেন, অবশ্যই নামায অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তখন তিনি বললেন, তাই যদি হয় তাহলে ঋতুবর্তী মহিলাদেরকে পরবর্তীতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও নামায কাযা করতে হয়না অথচ তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও রোযা আদায় করতে হয় কেন? এ ক্ষেত্রে তোমার যুক্তি কি?
ইমাম আবু হানিফা (রা.) বললেন, আমি জানি না। হযরত ইমাম জা’ফর সাদেক (রা.) বললেন, হে নু’মান! কান পেতে শুন,
আমার পিতা আমার দাদা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (দ.) ইরশাদ করেছেন,
“আল্লাহর নির্দেশের ক্ষেত্রে প্রথম যুক্তি দিয়ে যাচাই করেছিল ইবলীস শয়তান। আল্লাহ পাক ইবলীসকে নির্দেশ দিয়েছিলেন হযরত আদম (আ.) কে সেজদা করতে, তখন ইবলীস যুক্তি খাড়া করে বলেছিল, “আমি আদমের চেয়ে উত্তম, আমাকে সৃষ্টি করেছেন আগুন থেকে আর তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে”।
অতএব, যে ব্যক্তি দ্বীনকে যুক্তি দ্বারাই যাচাই করবে তাকে কেয়ামতের দিন ইবলীসের সাথী বানিয়ে দিবেন। কেননা সে
যুক্তি খাটিয়ে ইবলীসের অনুসরণ করেছে।
অতঃপর ইবনু আবি ইয়ালা (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম এর সন্তান! আপনি আবু হানিফাকে যে প্রশ্নগুলো করেছেন সেগুলোর উত্তর
অনুগ্রহ করে আমাদেরকে জানিয়ে দেবেন।
তখন ইমাম জা’ফর সাদেক (রা.) বললেন, আমার পিতা আমার দাদা থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
“আল্লাহ তা’য়ালা বড় দয়া ও এহসান করে বনী
আদমের চোখে লবন দান করেছেন, চোখ যেহেতু চর্বি জাতীয় তাতে লবন না থাকলে তা গলে যেত, আর চোখে লবণ না থাকলে দৃশ্যাবলী পানসে লাগত।
বনি আদমের উপর আল্লাহ তা’আলার এক মহা রহমত বা ইহসান যে, তিনি কানের ভিতর তিতা রেখে কীট-পতঙ্গ ঢুকে
ব্রেইনে আঘাত করা থেকে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছেন। ফলে
কানের মধ্যে কীট-পতঙ্গ ঢুকলে ভিতরের তিতা অনুভব করে ত্বরিত বের হয়ে পড়ে।
নাসিকা ইন্দ্রে উত্তাপ দিয়েও আল্লাহ পাক মানব জাতির উপর বড় দয়া ও রহম করেছেন। নাসিকা রন্দ্রের উত্তাপ ক্ষতিকর জীবাণু মিশ্রিত ঘ্রাণকে সেদ্ধ করে তা ব্রেনের জন্য সহনীয় করে
দেয়। ফলে তা সরাসরি ব্রেনে ক্ষতি করতে পারে না।
ইহাও মহান আল্লাহর এক মহা দান ও রহমত যে, তিনি বনি
আদমের জিহ্বায় মিষ্টতা রেখেছেন। এর ফলে বান্দা প্রত্যেক জিনিষের স্বাদ অনুভব করতে পারে আর মুখের
সুমিষ্ট ভাষা বলার সুযোগ হয়।
ইবনু আবি ইয়ালা (রহ.) বলেন, হে মহান ইমাম! আমাদেরকে সেই বাক্য সম্পর্কে বলুন যার প্রথম অংশ কুফরী আর শেষাংশ
ঈমান।
তখন তিনি বলেন, “বান্দা যখন ‘লা-ইলাহা’ বলে, তখন সে অবিশ্বাসী হয়ে যায়, আর যখন ‘ইল্লাল্লাহ’ বলে তখন সে ঈমানদার হয়ে যায়”।
ইবনু আবি ইয়ালা বলেন, হে মহান ইমাম! খুনের ক্ষেত্রে দুইজন সাক্ষী আর যেনার ক্ষেত্রে চারজন সাক্ষীর কারণ কি?
তিনি উত্তরে বললেন, যেহেতু খুনের অপরাধটা একজনের দ্বারা সংঘটিত হয় তাই দুইজন সাক্ষীর প্রয়োজন হয়, আর যেনা হচ্ছে দুইজনের যৌথ অপরাধ, তাই সাক্ষীও চারজন প্রয়োজন
হয়। সুবহানাল্লাহ।
(তথ্যসূত্র: হিলয়াতুল আউলিয়া লিল ইসফাহানী-৩/১৯৬, স্মরন ও সান্নিধ্য: আল্লামা হাশেমীর নোটখাতা)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন