★★★ সপ্তম হাদীছ( صحيح بشواهده )
হযরত আবু হুরায়রা (রঃ) থেকে বর্ণিতঃ রসূলুল্লাহ (সঃ) ইরশাদ করেছেন, শাবানের পনের তারিখ রাতে আল্লাহ তাআলা মুশরিক এবং বিদ্বেষী ছাড়া সকল বান্দাকে ক্ষমা করে দেন।
উক্ত হাদীসটিঃ
১। ইমাম হাইছামী তাঁর মাজমাউয যাওয়ায়েদে
২। বাযযার তাঁর মুসনাদে
সংকলন করেছেন।
░▒▓█► হাদীসটির মান :
প্রথম মন্তব্যঃ
এই হাদীছ সম্পর্কে হাফিয হাইছামী বলেনঃ
“ বাযযার তাঁর মুসনাদে এই হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। এর সনদে হিশাম ইবনু আবদির রহমান নামক একজন রাবী আছেন। তাঁর পরিচয় আমি জানি না। এছাড়া অন্যান্য সকল রাবী ছিক্বাহ। ”
( মাজমাউয যাওয়ায়েদঃ খ-৮, পৃ-৬৫ )
দ্বিতীয় মন্তব্যঃ
মাজমাউয যাওয়াদের মুহাক্কিক উক্ত হাদীছে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেনঃ
“ এই হাদীছটিকে হিশামের সমর্থন যোগায় মত কেউ বর্ণনা করেন নি এবং হিশাম থেকে আব্দুল্লাহ ইবনে গালিব হাদীছটি নিয়েছেন। ইবনু গালিব একজন নির্ভরশীল রাবী। ”
তৃতীয় মন্তব্যঃ
হাদীছ পর্যালোচক শায়খ শুয়াইব আল আরনাউত্ব এ হাদীছের ব্যাপারে মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বলের টীকায় আব্দুল্লাহ বিন আমরের সূত্রে হাদীছটিকে উদ্ধৃত করার পর বলেনঃ حديث صحيح بشواهده অর্থাৎ অন্যান্য হাদীছের পৃষ্ঠপোষকতায় এ হাদীছটি সহীহ বলে সাব্যস্ত। অতঃপর তিনি হাদীছটির সমর্থনে আরো সাতটি হাদীছ পেশ করেন। এর মধ্যে ষষ্ঠ হাদীছটি হলো আলোচ্য হাদীছটি। অবশেষে তিনি আবু হোরায়রার উক্ত হাদীছ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেনঃ
“ এসব সমর্থিত হাদীছগুলোর প্রত্যেকটির সূত্রে কিছুটা অসুবিধা থাকলেও সব হাদীছের সমষ্টি দ্বারা মূল হাদীছটি সহীহ ও শক্তিশালী হওয়ার মধ্যে কোন সন্দেহ নেই। অতএব আলোচ্য আবু হোরায়রা (রঃ) থেকে বর্ণিত আলোচ্য হাদীছ অন্যান্য হাদীছের সমর্থন পাওয়ায় সহীহ বলে সাব্যস্ত।”
( মুসনাদে আহমদঃ খ-১১, পৃ-৩১৬ )
সার কথাঃ
হযরত আবু হুরায়রা (রঃ) থেকে বর্ণিত উপরোক্ত হাদীসটিকে একজন রাবীর দুর্বলতার জন্য অনেক মুহাদ্দিসীনগণ একক ভাবে দুর্বল বলেছেন। কিন্তু হাদীস শাস্ত্রের নীতিমালা অনুযায়ী কোন দুর্বল হাদীসের সমর্থনে জন্য অন্য হাদীস থাকে, তাহলে ঐ হাদীসটি আর দুর্বল থাকে না। তখন দুর্বল হাদীসটি হাসান পর্যায়ে চলে যায় আর তা বর্ণনাও করা যায়। আর এ ক্ষেত্রে উপরোক্ত হাদীসটির সমর্থনে আবু বকর ছিদ্দীক (রঃ) এর সহীহ হাদীছ, হযরত মুয়ায বিন জাবাল (রঃ) এর সহীহ হাদীস, হযরত আবু মুসা আশআরী (রঃ) এর হাসান হাদীছ সহ মোট ৮ টি হাদীস পাওয়া যায়। তাই হাদীস শাস্ত্রের মূলনীতি অনুযায়ী এটি আর দুর্বল থাকবে না, বরং সমষ্টিগত ভাবে সহীহ বা হাসান হয়ে যাবে। তাই তো প্রখ্যাত হাদীস পর্যালোচক আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) এর বিশিষ্ট শিষ্য শায়খ শুয়াইব আল আরনাউত্ব উক্ত হাদীসটিকে সহীহ ও শক্তিশালী বলেছেন।
উপরন্তু ফাযায়েলে আমালের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীস গ্রহণযোগ্য ও আমলযোগ্য, এতে ইমামদের ইজমা রয়েছে। তাই এ হাদীসকে বাতিল বলার কোন অবকাশ নেই।
★★★ অষ্টম হাদীছ( حديث صحيح بشواهده )
হযরত আউফ ইবনু মালিক (রঃ) থেকে বর্ণিত, রসূল (সঃ) ইরশাদ করেছেনঃ আল্লাহ তাতালা শা’বান মাসের পনের তারিখ দিবাগত রজনীতে নিজ সৃষ্টিজীবের উপর বিশেষ রহমত প্রকাশ করেন। তাই মুশরিক ও হিংসাকাতর লোক ব্যতীত সকলকে তিনি ক্ষমা করে দেন।
উক্ত হাদীসটিঃ
১। ইমাম হাইছামী তাঁর মাজমাউয যাওয়ায়েদে
২। বাযযার তাঁর মুসনাদে
সংকলন করেছেন।
░▒▓█► হাদীসটির মান :
হাদীছটির অবস্থান পর্যালোচনাঃ
উক্ত বর্ণনা সম্পর্কে হাফিয হাইছামী বলেনঃ
“ বাযযার হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। উক্ত হাদীছের সনদে আব্দুর রহমান ইবনু যিয়াদ ইবনু আনআম রয়েছে। যাকে আহমদ ইবনু সালিহ ছিক্বাহ বলেছেন। অথচ অধিকাংশ ইমাম তাকে দুর্বল বলেছেন। আর ইবনু লাহীআহ অনির্ভরযোগ্য। অন্যরা সব ছিক্বাহ তথা নির্ভরযোগ্য। ”
( মাজমাউয যাওয়ায়েদঃ খ-৮, পৃ-৬৫ )
সারকথাঃ
উপরোক্ত পর্যালোচকদের মন্তব্য দ্বারা প্রতীয়মান হচ্ছে, উক্ত হাদীছে কেবল মাত্র একজন রাবী দুর্বল। আর ইবনু লাহী’আহ অনির্ভরযোগ্য হলেও অগ্রহণযোগ্য নয় কারণ তাঁর হাদীছ তো হাসান। এছাড়া অবশিষ্ট সকল রাবী নির্ভরযোগ্য।
( উল্লেখ্য, ইবনু লাহী'আহ সম্পর্কে যে দুর্বলতার কথা উল্লেখ রয়েছে, তা সহীহ ও হাসান হাদীছের মধ্যে পার্থক্যকারী দুর্বলতা, দুর্বল হাদীস হওয়ার জন্য যে দুর্বলতা, তা নয়। তা আমি আগেই প্রমাণ করে এসেছি। )
যেহেতু হাদীছটি আরো অন্যান্য হাদীছের সহযোগিতা ও সমর্থন পাচ্ছে, সুতরাং হাদীছটি প্রমাণিত বলা যায়। উপরন্ত শায়খ শুয়াইব আল আরনাউত্ব যিনি সময়কালের বিশিষ্ট হাদীছ পর্যালোচক, তিনি মুসনাদে আহমদের টীকায় শবেবরাত সম্পর্কিত হাদীছ এর সমর্থনকারী হাদীছ আখ্যা দিয়ে মোট সাতটি হাদীছ উল্লেখ করেছেন। উক্ত হাদীছটি সপ্তম নম্বরে এনেছেন। অতঃপর তিনি হাদীছগুলোর উপর যে মন্তব্য করেছেন তা পূর্বে উল্লেখ করেছি। এতে প্রমাণিত হয় যে, এসব হাদীছের সনদের ব্যাপারে কিছু আপত্তিকর মন্তব্য থাকলেও সবগুলো হাদীছ পারস্পরিক সমর্থন ও সহযোগিতার মা্ধ্যমে সহীহ ও শক্তিশালী বলে সাব্যস্ত।
★★★ নবম হাদীছ( حديث صحيح بشواهده واسناده مر سل جيد )
কাসীর ইবনু মুররাহ আল হাযরামী থেকে বর্ণিত, হুযুর (সঃ) বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা শাবানের পনের তারিখ রাত্রি অবতরণ করতঃ মুশরিক এবং হিংসাপরায়ণ লোক ছাড়া অন্যান্য সকলের গুনাহ মাফ করে দেন।
উক্ত হাদীছটি
১। ইবনে আবী শাইবা তাঁর মুসান্নাফে
২। হাফেজ আব্দুর রাজ্জাক তাঁর মুসান্নাফে
৩। ইমাম বায়হাকী তাঁর শুয়াবুল ঈমানে
৪। হাফেয মুনযিরী তাঁর তারগীব ওয়াত তারহীবে
সংকলন করেছেন।
░▒▓█► হাদীসটির মান :
হাদীছটির সূত্রের অবস্থানঃ
শুয়াবুল ঈমানে বর্ণিত সূত্রে রাবীগণের ব্যাপারে হাদীছ পর্যালোচকদের মন্তব্য নিম্নরূপঃ
১। রাবী আবুল হাসান বিন ফযল আলকাত্তান।
তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য হলঃ
খতীব বাগদাদী ইবনুল ইমাদ আল হাম্বলী এবং হাফিয যাহাবীসহ অনেকেই তাকে নির্ভরযোগ্য ও বহু হাদীছের বর্ণনাকারী হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন।
( তারীখে বাগদাদ )
২। আবু সাহাল বিন যায়াদ আল কাত্তান।
তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য হলোঃ
হাফেয যাহাবী এবং খতীব বাগদাদী তাঁর ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য ও সত্যবাদী বলে মন্তব্য করেছেন।
( তারীখে বাগদাদ; সিয়ারু আলামিন নুবালা )
৩। ইসহাক ইবনে হাসান আল হারবী।
তাঁর সম্পর্কে হাফেয যাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আহমদ বিন হাম্বল এবং ইবনু হাজার আসকালানী সকলেই বলেছেনঃ
ثقة حجة
অর্থাৎ নির্ভরযোগ্য ও দলীলরূপে সাব্যস্ত।
( দেখুনঃ মীযানুল ইতেদালঃ ১/১৯০ )
৪। আফফান বিন মুসলিম আল বাসারী।
তাঁর সম্পর্কে ইবনে মুঈন আবু হাতিম এবং ইবনু হাজার মন্তব্য করেনঃ
اصحاب الحديث ثقة ثبت متقن
অর্থাৎ বড় মাপের মুহাদ্দিছ, নির্ভরযোগ্য, বিশ্বস্ত, অতি মজবুত।
৫। আব্দুল ওয়াহিদ বিন যিয়াদ।
তাঁর সম্পর্কে ইবনে সাআদ আবু হাতিম, আবু যুরআ এবং ইবনে হাজার বলেনঃ
ثقة
অর্থাৎ নির্ভরযোগ্য।
৬। হাজ্জাজ বিন আরত্বাত্ব।
তাঁর সম্পর্কে আবু যুরআ বলেনঃ
صدوق يدلس
অর্থাৎ সত্যবাদী তবে তাদলীস করেন।
আবু হাতিম বলেনঃ
صدوق يدلس عن الضعفاء يكتب حديثه
অর্থাৎ সত্যবাদী, তাদলীস করেন তবে তাঁর বর্ণিত হাদীছ গ্রহণযোগ্য।
( তাহযীবুল কামাল )
ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন বলেন, হাজ্জাজ ইবনে আরত্বাত্ব ইমাম মাকহূল থেকে হাদীছ শুনেছেন। বহুক্ষেত্রে তা স্পষ্টভাবে
سمعت مكحولا
বলে উল্লেখ করেছেন।
( দেখুনঃ তারীখে বাগদাদ )
ইমাম নাসাঈ মন্তব্য করেছেনঃ তিনি তেমন মজবুত নন।
ইবনে হাজার বলেনঃ সত্যবাদী তবে অনেক বেশি ভুল করেছেন।
সময়কালের হাদীছ পর্যালোচক শায়খ আল আরনাউত্ব তাঁর ব্যাপারে মন্তব্য করেনঃ
তিনি সত্যবাদী, হাদীছ বর্ণনায় উত্তম ব্যক্তি, তাদলীস করেন, سمعت বা حدثنا না বললে সে বর্ণনা গ্রহণযোগ্য হয় না, তাঁর ব্যাপারে বেশি ভুল করার মন্তব্য অতিরঞ্জিত।
( তাহরীর তাকরীবুত তাহযীবঃ ১১১৯ )
৭। মাকহূল (রহঃ)। প্রসিদ্ধ ফকীহ ও মুহাদ্দিছ। তিনি সর্বসম্মতিক্রমে
ثقة فقيه تابعى كثير الارسال
নির্ভরযোগ্য, ফিক্বহের ইমাম, তাবেয়ী ও তার ইরসাল করা প্রসিদ্ধ।
হাদীছটির অবস্থান নিয়ে পর্যালোচনাঃ
হাফিয মুনযিরী হাদীছটিকে আততারগীব ওয়াত-তারহীব এ এনেছেন, তিনি বলেনঃ
“ বাইহাকী হাদীছটি বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন এটি একটি চমৎকার মুরসাল হাদীছ। হাদীছটি অন্য সূত্রেও বর্ণিত আছে। মাকহূল তা বর্ণনা করেছেন। আবু ছা’লাবাহ (রঃ) থেকে সেটিও চমৎকার মুরসাল হাদীছ। ”
সারকথাঃ
হাদীছটি মুরসাল, তবে গ্রহণযোগ্য, উত্তম মুরসাল। মুরসাল হানাফী ও মালেকীদের নিকট এমনিতেই গ্রহণযোগ্য। جيد (উত্তম) হলে তো আরো ভাল কথা। তাছাড়া এ হাদীছটি বহু হাদীছের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতায় নিঃসন্দেহে গ্রহণযোগ্য ও আমলের ক্ষেত্রে সঠিক বলে সাব্যস্ত।
আহলে হাদীস/সালাফী ভাইদের কাছে প্রশ্ন ও দাওয়াতঃ
উপরে বর্ণিত হাদীসটিই মুরসাল হাদীস এবং উত্তম মুরসাল । যা হানাফী ও মালেকী ইমামদের নিকট এমনিতেই গ্রহণযোগ্য, উপরন্তু শাফেঈ ও হাম্বলী মাযহাবের মুরসাল হাদীস মানার পিছনে যে শর্ত আছে, তাও পূরণ করে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন