সকল মাযহাবই সঠিক পথের অনুসারী এবং মানুষকে সঠিকভাবে পথ প্রদর্শন করে গেছেন:-
আল্লাহ তায়ালার কাছে ফুক্বাহাদের মর্যাদা
আল্লাহ তায়ালা কতটা মর্যাদা দিয়েছেন ফুক্বাহায়ে কিরামকে, হাদীস কুরআনের বিভিন্ন বর্ণনা দেখলেই তা আমাদের বুঝে আসে।
عَنْ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- « إِذَا حَكَمَ الْحَاكِمُ فَاجْتَهَدَ فَأَصَابَ فَلَهُ أَجْرَانِ وَإِذَا حَكَمَ فَاجْتَهَدَ فَأَخْطَأَ فَلَهُ أَجْرٌ
হযরত আমর বিন আস রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন-“যখন কোন বিশেষজ্ঞ হুকুম দেয়, আর তাতে সে ইজতিহাদ করে তারপর সেটা সঠিক হয়, তাহলে তার জন্য রয়েছে দু’টি সওয়াব। আর যদি ইজতিহাদ করে ভুল করে তাহলে তার জন্য রয়েছে একটি সওয়াব। {সহীহ বুখারী, হাদিস নং-৬৯১৯, সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং-৩৫৭৬, সহীহ মুসলিম, হাদিস নং-৪৫৮৪}
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন-
وَلَكِنَّ الْمُنافِقِينَ لا يَفْقَهُونَ} [المنافقون:7]
অর্থাৎ মুনাফিকরা ফক্বীহ হতে পারেনা। [সুরা মুনাফিকুন-৭]
সুতরাং ফক্বীহ কখনো মুনাফিক হতে পারেনা।
আর রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন-একজন ফক্বীহ শয়তানের উপর একশত আবেদের চেয়ে’ বেশি কষ্টকর। [সুনানে তিরমিযী, হাদিস নং-২২২]
“সোজা রাস্তায় যারা চলবে তারা হবে সফলকাম। আর যারা বাকি আঁকাবাঁকা রাস্তায় চলবে তারা হবে ধ্বংস”। {সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং-১১}
আল্লামা ইমাম কুরতুবী রঃ তাফসীরে কুরতুবীতে লিখেন-
وقد مضى في "آل عمران" معنى قوله عليه السلام : "تفرقت بنو إسرائيل على اثنتين وسبعين فرقة وأن هذه الأمة ستفترق على ثلاث وسبعين" . الحديث. وقد قال بعض العلماء العارفين : هذه الفرقة التي زادت في فرق أمة محمد صلى الله عليه وسلم هم قوم يعادون العلماء ويبغضون الفقهاء ، ولم يكن ذلك قط في الأمم السالفة.( الجامع لأحكام القرآن
المؤلف : أبو عبد الله محمد بن أحمد بن أبي بكر بن فرح الأنصاري الخزرجي شمس الدين القرطبي (المتوفى : 671)
প্রথম উম্মতের মাঝে ইজতিহাদ ছিলনা। তাই ইজতিহাদের দুশমনও ছিলনা। এই উম্মতের মাঝে ইজতিহাদ আছে। তাই ইজতিহাদের দুশমনও আছে। আর এই উম্মতের অতিরিক্ত জাহান্নামী ফিরক্বা হল ইজতিহাদের দুশমন ফুক্বাহায়ে কিরামের দুশমন দল। {তাফসীরে কুরতুবী, তাফসীর সূরাতুল আনআম}
আহলে হাদিস নেতা ইমাম তাইমিয়া এর মতে- ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ) সাধারন লোকদেরকে ইসহাক, আবু উবাইদা, আবু সাওর ও আবু মুসয়াব প্রমুখ ইমামের তাকলীদ করার নির্দেশ দিতেন। ইমাম আবু দাউদ, উসমান বিন সাইদ ইরাহীম আর হারবী,আবু বাকার আল-আসরম, আবু যরয়া, আবু হাতিম সিজিস্তানী, ইমাম মুসলিম প্রমুখ ছাত্রদেরকে তাকলীদের ব্যাপারে বলতেন- তোমাদের জন্য শরীয়তের উৎস আকড়ে ধরাই ওয়াজিব।
( ফাতোয়ায়ে ইবনে তাইমিয়া)
এখন বলুন শরীয়তের উতস কি? নিশ্চই কুরআন হাদিস। হাদিস কারা সংকলন করেছে? নিশ্চই তাবেয়ী তাবে-তাবেয়ীগন নাকি লা-মাযহাবীদের জন্য নাজিল হয়েছিল আলাদাভাবে? তাহলে কোনটা সঠিক হাদিস বুঝেছি কিভাবে? যারা সংকলন করেছে তারা বলেছে এটা উমুখ উমুখ বর্ননা করেছে এটা বিশ্বাসযোগ্য এটা সহীহ। আমরা তাদের কথামতই মেনে নিয়েছিলাম প্রথমে সহিহ কি দুর্বল কি আর জাল কি? আর আজ লা- মাযহাবী শয়তান গুলো তাদের থেকে শিখে গুরো কে চিনে না,বাহ!!!
হানাফী মাযহাব এর তাক্বলিদ সম্পর্কে বলি কেন এই মাযহাবের তাক্বলিদ করব :-
ভাই জাকির নায়েক কি ধারনা আবু হানিফা রহ. কুরআন ও হাদীস জানতেন না
বা কুরআন ও হাদীস বাদ দিয়ে বাইবেল ও গীতা থেকে মাসআলা বের করেছে !!!!!
1. ইমাম বোখারীর অন্যতম উস্তাদ মক্কী বিন ইব্রাহীম (রহ.) (মৃতু- 215 হিঃ) যার সনদে ইমাম বুখারী (রহ.) অধিকাংশ ‘সুলাসিয়্যাত হাদীস’ বর্ণনা করেছেন। এই মক্কী বিন ইব্রাহীম (রহ.) ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর ছাত্র। তিনি ইমাম আবু হানীফা (রহ.) সম্পর্কে বলেন,
“আবু হানীফা তাঁর সময়কালের শ্রেষ্ঠ আলেম ছিলেন” - মানাক্বেবে ইমাম আজম রহ. 1/95
আবার হাফিয মযযী (রহ.) বলেন: মক্কী বিন ইব্রাহীম ইমাম আবু হানীফা (রহ.) সম্পর্কে বলেন,
“তিনি তাঁর কালের সবচে’ বড় আলিম ছিলেন” – তাহ্যীবুত তাহযীব-এর টিকা- 10ম খন্ড, 452পৃ.
(এখানে একটি কথা বিশেষভাবে স্মরণ রাখতে হবে, প্রাচীন আলিমগণ ‘ইলম’ বলতে ‘ইলমে হাদীস’ই বুঝাতেন। তাই ইমাম আবু হানীফা (রহ.) কে বড় আলিম বলার অর্থ- ‘হাদীস শাস্ত্রের বড় আলিম’ এতে কোন সন্দেহ নেই।)
2. ইমাম আবু দাউদ বলেন,
নিঃসন্দেহে আবু হানীফা ছিলেন একজন শেষ্ঠ ইমাম।- তাহজীব 1/445
3. জরহে তাদিলের (সনদ পর্যালোচনা শাস্ত্র) অন্যতম ইমাম ইয়াহ্ইয়া ইবনে মুঈন (মৃতু- 233হিঃ) বলেন,
“আবু হানীফা ছিলেন হাদীস শাস্ত্রের গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি”- তাহবীবুত্তাহজীব 5/630
4. আলী ইবনে মাদানী (মৃতু- 234 হিঃ) বলেন,
“আবু হানীফা হাদীস শাস্ত্রে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। তার মধ্যে কোন দোষক্রুটি ছিল না। - জামঈ বয়ানিল ইল্ম 2/1083
5. প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস হাফিজ ইয়াহ্ইয়া বিন হারুন (মৃতু- 206 হিঃ) বলেন,
“আবু হানীফা ছিলেন সমকালীন শ্রেষ্ঠতম জ্ঞানী ও সত্যবাদী” –আহবারে আবু হানীফা 36
6. আল্লামা হাফিয ইবনে হাজার আসক্বালানী রহ. বলেন-
“ইমাম আবু হানীফা রহ.-র মুত্যু সংবাদ শুনে ফিক্বাহ ও হাদীস শাস্ত্রের সুপ্রসিদ্ধ ইমাম, শাফঈ মাযহাবের প্রধানতম সংকলক হযরত ইবনে জরীহ রহ. গভীর শোক প্রকাশ করে বলেছিলেন,
“আহ! ইলমের কি এক অফুরন্ত খনি আজ আমাদের হাতছাড়া হলো”। -
তাহযীবুত্তাহযীব খন্ড ১, পৃ: ৪৫০)
7: একবার হযরত ইয়াহয়া ইবনে মুঈনকে প্রশ্ন করা হলো- হাদীসশাস্ত্রে আবু হানীফা রহ. কি আস্থাভাজন ব্যক্তি? সম্ভবতঃ প্রচ্ছন্ন সংশয় আঁচ করতে পেরে দৃপ্তকন্ঠে তিনি উত্তর দিলেন- হ্যা, অবশ্যই তিনি আস্থাভাজন! অবশ্যই তিনি আস্থাভাজন! (মানাকিবুল ইমামমুল আ’যামি লিলমাওয়াফিক- খন্ড:1, পৃষ্ঠা 192)
দেখুন ওনারা কি কখনো হাদিসের বহির্ভুত জ্ঞান কাউকে প্রচার করতেন কিনা?
১- ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর নসিহত :
(ক) ‘যখন ছহীহ হাদীছ পাবে, জেনো সেটাই আমার মাযহাব’।(হাশিয়াহ ইবনে আবেদীন ১/৬৩।)
(খ) ‘আমরা কোথা থেকে গ্রহণ করেছি, তা না জেনে আমাদের কথা গ্রহণ করা কারো জন্য বৈধ নয়’।(ঐ ৬/২৯৩।)
(গ) ‘যে ব্যক্তি আমার দলীল জানে না, আমার কথা দ্বারা ফৎওয়া প্রদান করা তার জন্য হারাম’।(ড. অছিউল্লাহ বিন মুহাম্মাদ আব্বাস, আত-তাক্বলীদ ওয়া হুকমুহু ফী যুইল কিতাব ওয়াস-সুন্নাহ, পৃঃ ২০।)
(ঘ) ‘নিশ্চয়ই আমরা মানুষ। আমরা আজকে যা বলি, আগামীকাল তা থেকে ফিরে আসি’।(ঐ।)
(ঙ) ‘তোমার জন্য আফসোস হে ইয়াকুব (আবু ইউসুফ)! তুমি আমার থেকে যা শোন তাই লিখে নিও না। কারণ আমি আজ যে মত প্রদান করি, কাল তা প্রত্যাখ্যান করি এবং কাল যে মত প্রদান করি, পরশু তা প্রত্যাখ্যান করি’।(ঐ।)
(চ) ‘আমি যদি আল্লাহর কিতাব (কুরআন) ও রাসূলুললাহ (ছাঃ)-এর কথার (হাদীছ) বিরোধী কোন কথা বলে থাকি, তাহ’লে আমার কথাকে ছুঁড়ে ফেলে দিও’।(ছালেহ ফুল্লানী, ইক্বাযু হিমাম, পৃঃ ৫০।)
২- ইমাম মালেক (রহঃ)-এর নসিহত :
(ক) ‘আমি একজন মানুষ মাত্র। আমি ভুল করি, আবার ঠিকও করি। অতএব আমার সিদ্ধান্তগুলো তোমরা যাচাই কর। যেগুলো কুরআন ও সুন্নাহর অনুকূলে হবে সেগুলো গ্রহণ কর। আর যেগুলো কুরআন ও সুন্নাহর প্রতিকূলে হবে তা প্রত্যাখ্যান কর’।(ইমাম ইবনু হাযম, আল-ইহকাম ফী উছূলিল আহকাম, ৬/১৪৯।)
(খ) ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পরে এমন কোন ব্যক্তি নেই, যার সকল কথাই গ্রহণীয় বা বর্জনীয়, একমাত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ব্যতীত’।(ঐ ৬/১৪৫।)
৩- ইমাম শাফেঈ (রহঃ)-এর নসিহত :
(ক) ‘যদি তোমরা আমার বইয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাহ বিরোধী কিছু পাও, তাহ’লে রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাহ অনুযায়ী বল এবং আমার কথাকে প্রত্যাখ্যান কর’। অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, ‘তোমরা রাসূল (ছাঃ)-এর কথারই অনুসরণ কর এবং অন্য কারো কথার দিকে দৃকপাত কর না’।(ইমাম নববী, আল-মাজমূ, ১/৬৩।)
(খ) ‘আমি যেসব কথা বলেছি, তা যদি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছহীহ হাদীছের বিপরীত হয়, তবে রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছই অগ্রগণ্য। অতএব তোমরা আমার তাক্বলীদ কর না’।(ইবনু আবী হাতেম, পৃঃ ৯৩, সনদ ছহীহ।)
(গ) ‘রাসূলুললাহ (ছাঃ)-এর প্রত্যেকটি হাদীছই আমার কথা, যদিও আমার নিকট থেকে তোমরা তা না শুনে থাক’।(ঐ।)
৪- ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ)-এর নসিহত :
(ক) ‘তুমি আমার তাক্বলীদ কর না এবং তাক্বলীদ কর না মালেক, শাফেঈ, আওযাঈ ও ছাওরীর। বরং তাঁরা যে উৎস হ’তে গ্রহণ করেছেন, সেখান থেকে তোমরাও গ্রহণ কর’।(ইলামুল মুওয়াক্কি’ঈন, ২/৩০২।)
(খ) ‘যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাদীছকে প্রত্যাখ্যান করল, সে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেল’।(মুকাদ্দামাতু ছিফাতি ছালাতিন নাবী (ছাঃ), পৃঃ ৪৬-৫৩।)
এইগুলো পড়ে কি মনে হচ্ছে যে তারা কুরআন সুন্নাহ বিরোধী মতামতকে গ্রহন করতে কখনো বলেছেন? নাকি দিয়েছেন?
ভারতবর্ষের গাইরে মুক্বাল্লিদ্ ও পৃথিবীর অন্যান্য গাইরে মুক্বাল্লিদ্দের মধ্যে যোগসূত্র নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোন থেকে নেয়া :-
১।
তৃতীয় শতাব্দীর শুরু লগ্নে ২০২ হিজরীতে প্রখ্যাত মুহাদ্দিস দাউদে যাহেরীর জন্ম। তিনি শরীয়তের সকল পর্যায়ে কিয়াস বর্জন করে কেবল কুরআন-হাদীসের প্রত্যক্ষ ও যাহেরী অর্থের ভিত্তিতে চলার মতবাদ রচনা করেন। তাঁর মতে ক্বিয়াস শরীয়তের কোন দলীল হতে পারে না। যদিও এ ক্বিয়াস কোরআন-হাদীসের আলোকে এবং কোন বিষয়ে কুরআন-হাদীসের স্পষ্ট উক্তি না থাকা সত্ত্বেই হোক না কেন! এ জন্যই তাকে দাউদে যাহেরী বা “ প্রত্যক্ষদর্শী ” এবং তাঁর অনুসারীদেরকে যাহেরিয়া বলা হয়।
( মু’জামুল মুয়াল্লিফিন, উমর রেজাঃ পৃ-১/৭০০ জীবনী নং-৫২৪০ ও আল-আলম খাইরুদ্দীনঃ পৃ-২/৩৩৩ )
২।
চতুর্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ৩৮৪ হিজরীতে আল্লামা ইবনে হাযাম যাহেরীর জন্ম হয়। তিনি প্রথমে ছিলেন শাফেয়ী মায্হাবের অনুসারী। পরবর্তীতে তিনি দাউদে যাহেরীর মায্হাব অবলম্বন করেন এবং এক পর্যায়ে সকল মায্হাব ত্যাগ করে তাক্বলীদ্কে হারাম বলতে আরম্ভ করেন। এমনকি মুজতাদিহ ইমামগণকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও লাগামহীনভাবে তাদের প্রতি কটুক্তি করতে থাকেন। তার এ বাড়াবাড়ির অসংখ্য নযীর তার রচনাবলীতে বিদ্যমান রয়েছে।
৩।
হিজরী ৮ম শতাব্দীর ইমাম আল্লামা ইবনে তাইমিয়্যা (মৃতঃ ৭২৮ হিজরী) ও হাফেজ ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রহঃ) (মৃতঃ ৭৫১ হিঃ) হাম্বলী মায্হাবের অন্যতম অনুসারী ছিলেন। তবে কিছু কিছু ইজতেহাদী বিষয়ে তাদের ব্যতিক্রমধর্মী মতামত তথা যাহেরিয়াদের সঙ্গে সামঞ্জস্যতা ছিল।
এ কারণেই আল্লামা ইবনে বতুতা (রহঃ) ইবনে তাইমিয়্যা সম্বন্ধে লিখেনঃ
“ ইবনে তাইমিয়্যা কিছু বিষয়ে দক্ষতার সাথে আলোচনা করেন, তবে তার মাথায় কিছু ব্যতিক্রমধর্মী (বাতিল) চিন্তা-চেতনাও রয়েছে। ”
( তুহ্ফাতুন নাজ্জার থেকে মাওলানা ইসমাইল সাম্বলী প্রনীত তাক্বলীদে আইম্মাঃ পৃ-৫৩ )
এবং হাফেজ যাহাবী (রহঃ) ইবনুল ক্বাইয়্যিম সম্বন্ধে লিখেনঃ
“ তিনি নিজস্ব মতেই আত্নতৃপ্ত। মাথায় কিছু বৈচিত্র্য রয়েছে, যার ফলে গর্হিত অনেক কিছু প্রকাশ পেয়েছে। ”
( আলমু’জাম থেকে তাক্বলীদে আইম্মাঃ পৃ-৫৪ )
৪।
দ্বাদশ শতাব্দীর প্রখ্যাত আলিম মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহ্হাব নজদী (মৃতঃ ১২০৬ হিঃ) মূলত হাম্বলী মায্হাবেরই মুক্বাল্লিদ্ ছিলেন।
তবে অনেক বিষয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ির ফলে তাঁর সঙ্গে তদানীন্তন সউদী আলেম উলামাদের মহামতানৈক্য সৃষ্টি হয়। তিনিই মহানবী (সঃ) এর রওজার উপর বিস্তৃত গম্বুজটি ভেঙ্গে দেয়ার পরিকল্পনা করেন এবং ভিন্ন মতাবল্মীদেরকে পবিত্র হজ্ব পালনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন ও তাদেরকে কাফির, মুশরিক ইত্যাদি জঘন্যতম আখ্যায় আখ্যায়িত করতে থাকেন। ফলে ভয়াবহ ফিৎনা-ফাসাদ ও বিশ্ব মুসলিম সমাজে পারস্পরিক কোন্দলের সূচনা হয়। পক্ষান্তরে যারা তার মতবাদের তাক্বলীদ করতে থাকে তাদেরকে মুসলমানগণ ওহ্হাবী বলে আখ্যায়িত করতে থাকেন। এদিকে ভারতবর্ষের লা-মায্হাবীরাও যেহেতু নিছক ঝগড়া-বিবাদ ও মুসলমানদের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টির ষড়যন্ত্র হিসেবে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহ্হাব নজদীর অন্তঃসারশূণ্য বিচিত্র মতবাদ গ্রহণ করে যেত, তাই তাদেরকেও মুসলমানগণ ওহ্হাবী বলে আখ্যায়িত করতে থাকেন। আর তারা নিজেদেরকে মুহাম্মদী বা আহলে হাদীস বলে প্রচারের চেষ্টায় মেতে উঠে।
৫।
এ ধারার শেষ ব্যক্তি ক্বাযী শাওকানী (মৃতঃ ১২৫৫ হিজরী) মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহ্হাব নজদীরই সমসাময়িক ছিলেন। তিনি প্রথমতঃ ছিলেন শিয়া মতালম্বী। তার রচনাবলী প্রায়ই পরস্পর বিরোধপূর্ণ ও নিরপেক্ষতাহীন মতামতে ভরপুর।
দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যেতে পারে হানাফী মায্হাব অনুযায়ী “ বিতর ” নামায্ ওয়াজীব। এ মতামত খন্ডন করার জন্য ইমাম শাওকানী হাদীসে মুয়া’য্ (রঃ) পেশ করেছেন, যাতে বলা হয়েছে যে, “ আল্লাহপাক রাত্র দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামায্ ওয়াজিব্ তথা ফরয করেছেন ” এ ছাড়াও তিনি হাদীসে আ’রাবী পেশ করেছেন, যাতে মহানবী (সঃ) গ্রাম্য লোকটিকে মাত্র পাঁচ ওয়াক্ত নামায্ আদায় করতে বলায় তিনি প্রশ্ন করেন যে আমার উপর এ ছাড়া কি আর কোন নামায্ আছে? তদুত্তরে মহানবী (সঃ) ইরশাদ করেন “ না, এ ছাড়া সমস্তই নফল। ”
এ হাদীস দু’টির মাধ্যমে শাওকানী সাহেব প্রমাণ করেন যে, পাঁচ ওয়াক্ত নামায্ ব্যতীত আর কোন নামায্ই ওয়াজিব বা ফরয নয়। তাই “ বিতর ” নামায্ও পাঁচ ওয়াক্তের বহির্ভূত বিধায় ওয়াজিব হতে পারে না বরং নফল নামাযেরই অন্তর্ভূক্ত।
( নাইলুল আওতারঃ পৃ - ৩/৩১ )
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপ ও হাস্যকর বিষয় হল যে, তিনি মাত্র এর কয়েক পৃষ্ঠা পরই “ তাহিয়্যাতুল মসজিদ ” নামাযের বর্ণনায় উপরোক্ত হাদীসগুলো দৃষ্টিগোচর করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের বহির্ভূত “ তাহিয়্যাতুল মসজিদ ” নামায্কে ওয়াজিব প্রমাণের ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। অথচ তিনি নিজেও “ তাহিয়্যাতুল মসজিদ ” সুন্নত হওয়ার পক্ষে সকল উলামায়ে কিরামের ইজ্মা (সর্বসম্মত রায়) নকল করেছেন।
( নাইলুল আওতারঃ পৃ - ৩/৬৮ )
সুতরাং তার এ ধরণের কর্মকাণ্ড পক্ষপাতিত্ব, অনিরপেক্ষতা ও নিছক গোঁড়ামি বৈ আর কি?
৬) উল্লেখ্য যে, ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ, ইবনুল ক্বাইয়্যিম ও মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহ্হাব তারা ছিলেন হাম্বলী মাযহাবের মুক্বাল্লিদ ও অনুসারী। যদিও তাদের মধ্যে কিছু বিতর্কিত বিষয়ও ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমান গাইরে মুক্বাল্লিদ্রা তাদের গুণগত বিষয়গুলো উপেক্ষা করে কেবল বিতর্কিত বিষয়গুলো অবলম্বন করতঃ মুসলমানদের মধ্যে ফিৎনা-ফাসাদ ও মতানৈক্যের যোগান দিচ্ছে।
গাইরে মুক্বাল্লিদ্দের বিচিত্র নাম ও এর রহস্যঃ
১।
নবজাত শিশুর যেমন প্রথমেই কোন নাম থাকে না, কিছু দিন পর তার একটা নাম রাখা হয়, পছন্দ না হলে প্রয়োজনে তাও আবার পরিবর্তন করা হয়, অনুরুপভাবে ভারতবর্ষে নবজন্মা গাইরে মুক্বাল্লিদ নামক বিদ্য়া’ত ও ভয়াবহ ফিৎনাটিরও প্রাথমিক পর্যায়ে কোন নাম ছিল না। তাদের ভ্রান্ত তৎপরতা লক্ষ্য করে জনগণ যখন তাদেরকে “ ওহ্হাবী ” বা “ লা-মায্হাবী ” বলতে থাকে তখন তারা নিজেদেরকে “ মুহাম্মদী ” বলে ঘোষণা করে এবং পর্যায়ক্রমে সুবিধামত “ মুয়াহ্হিদ ” “ গাইরে মুক্বাল্লিদ ” “ আহ্লে হাদীস ” ইত্যাদি নাম বরাদ্দ করতে থাকে। সউদী আরবে তেল, পেট্রোলের পয়সা জমজমাট হওয়ার মুরাদে আরবীদেরকে ধোঁকা দিয়ে পেট পালার ব্যবস্থা হিসেবে বর্তমানে তারাই “ সালাফী ” নামে আত্নপ্রকাশ করেছে।
২।
এ ব্যাপারে গাইরে মুক্বাল্লিদ্দেরই অন্যতম ব্যক্তি মৌলভী মুহাম্মাদ শাহজাহানপুরীর উক্তি ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া তাদের অনেকেরই বই-পুস্তকে এর অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। তন্মধ্য হতে গাইরে মুক্বাল্লিদ আলিম মৌলভী আসলাম জিরাজপুরী তার বিশিষ্ট রচনা “ নাওয়াদিরাতে ” লিখেন,
“ প্রথমত এ জামাত নিজেদের বিশেষ কোন নাম রাখেনি। মাও: ইসমাইল শহীদ (রহ.) এর শাহাদাতের পর প্রতিপক্ষের লোকেরা যখন দুর্নাম করা জন্য তাদেরকে ওহ্হাবী বলতে শুরু করে, তখন তারা নিজেরদেকে “ মুহাম্মাদী ” বলতে থাকে, অত:পর এ নামটি পরিহার করে “ আহলে হাদীস ” উপাধি চয়ন করে যা আজ পর্যন্ত বলবৎ রয়েছে। ”
(নাওয়াদিরাতঃ পৃ: ৩৪২)
মুহাম্মাদী কে?
ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে যে, ১২৪৬ হিজরীর পর এই উপমহাদেশে সৃষ্ট বিদ্য়া’ত ও নতুন ফিরক্বাটিকে মুসলমানগণ যখন ওহ্হাবী বলে আখ্যায়িত করতে থাকেন তখন তারা নিজেদেরকে মুহাম্মাদী বলে দাবী করে। সে হিসেবে মৌলভী আব্দুল হক্ব বেনারসী ও মৌঃ নজীর হুসাইন ভারতবর্ষের প্রথম মুহাম্মাদী নামের দাবীদার। অনুরূপ ভাবে তাদের তদানীন্তন অনুসারীরাও মুহাম্মাদী নামেই আত্নপ্রকাশ করতো। এ ধারায় নবাব ছিদ্দিক্ব হাসান খান ১২৮৫ হিজরীতে মৌঃ আব্দুল হক্ব বেনারসী থেকে লিখিত ভাবে মুহাম্মাদী উপাধি লাভ করেন।
( মায্হাবে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহঃ পৃ – ৩৬ )
মুহাম্মাদী নামের রহস্য
১।
মুহাম্মাদী বলে তারা বুঝাতে চায় যে, তারা সরাসরি নবী মুহাম্মাদ (সঃ) এর অনুসারী, তারা কোন মায্হাবের তাক্বলীদ বা অনুসরণ করে না তাই তারা হানাফী নয়, নয় শাফেয়ী, মালেকী বা হাম্বলী; বরং তারা মুহাম্মাদী। কিন্তু প্রশ্ন জাগে মুহাম্মাদ (সঃ) এর সত্যিকার অনুসারীদেরকেই যদি মুহাম্মাদী বলতে হয়, তাহলে হযরত সাহাবায়ে কিরাম (রঃ) ও তাবেয়ীনই তো এর সর্ব প্রথম ও সর্বাধিক উপযুক্ত ধারক ও বাহক, তাঁরা কেন তা গ্রহণ করেননি? তাঁদের উপাধি মুহাম্মাদী নয় কেন? এ শব্দের ব্যবহার ও প্রয়োগের সূচনা ১২০০ হিজরীর পরে কেন?
২।
নবাব ছিদ্দিক্ব হাসান খান অবশ্য এ প্রশ্নের উত্তর দিতে যেয়ে চতুর্থ শতাব্দীর শেষার্ধের মুহাদ্দিস আবু হাফস উমার বিন আহমদ ইবনে শাহীন এর কথা উল্লেখ করেছেন যে, ইবনে শাহীনের নিকট কোন মায্হাবের আলোচনা আসলে তিনি বলতেনঃ “ আমি মুহাম্মাদী মায্হাবের ”।
( তাযকিরাতুল হুফ্ফাজঃ পৃ – ৩/১৮৪; হেদায়াতুল মাসাইল ছিদ্দিক্ব হাসান খানঃ পৃ - ৫২৫)
কিন্তু মুহাদ্দিস ইবনে শাহীনের এ উক্তি নকল করার দ্বারা তাদের কী লাভ? তিনিও তো ৪র্থ শতাব্দীর শেষার্ধের লোক। তাঁর মৃত্যু ৩৮৫ হিজরীতে। আর চার ইমামের অনুসরণের ধারা তো এর অনেক পূর্বেকার। সুতরাং তাদের বক্তব্য অনুযায়ী তারাই ৪র্থ শতাব্দীর শেষার্ধে বিদ্য়া’তের সূচনাকারী দল। এ ছাড়া, ইবনে শাহীন তো কেবল মাত্র একজন বিশেষজ্ঞ আলিম ছিলেন। শরীয়তের সর্বক্ষেত্রে অনুসরণ যোগ্য হিসেবে মুসলিম উম্মাহ তাকে গ্রহণ করেননি। হাফেয যাহাবী (রহঃ) তাঁর অসংখ্য ভুল ত্রুটির এক বিরাট দাস্তান উল্লেখ করেছেন।
( তাযকিরাতুল হুফ্ফাজঃ পৃ – ৩/১৮৪ )
তিনি তো কোন সাহাবী ছিলেন না, তাবেয়ীও ছিলেন না। গাইরে মুক্বাল্লিদ্রা কি কোন সাহাবী বা তাবেয়ী অথবা হুজুর (সঃ) এর পবিত্র হাদীসে উল্লেখিত উত্তম যুগ তথা স্বর্ণযুগের কারও উপাধি মুহাম্মাদী প্রমাণ করতে পারবেন? সকল মুহাম্মাদী নামের ধব্জাধারীরা একত্রিত হয়েও যদি সক্ষম হবেন বলে মনে করেন তবে প্রমাণ করে দিন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন