মঙ্গলবার, ২৩ জুন, ২০১৫

ইয়াযীদ সম্পর্কে আহলুস- সুন্নাহ এর ফতোওয়া (পর্ব ১) : -



অনুবাদ করেছেন : কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
From : Ahlus-Sunnah.com

ইয়াযীদ (আল্লাহতা’লা যেন তার যা প্রাপ্য তা তাকে দেন এবং তার বাবা হযরত আমীরে মোয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর প্রতি সন্তুষ্ট হন)

বর্তমানে এটি পরিলক্ষিত হচ্ছে যে কিছু মানুষ আহলে বায়ত (মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পরিবার সদস্য ও আত্মীয়-পরিজন)-এর প্রতি নিজেদের প্রত্যক্ষ, এমন কি পরোক্ষ ঘৃণার বহিঃপ্রকাশস্বরূপ এয়াযীদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড ধামাচাপা দিতে সচেষ্ট এবং এরই ধারাবাহিকতায় তারা তাকে এক মহান ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিত্রিত করছে। আল্লাহর অনুগ্রহে আমরা এই লেখায় ইসলামের এই বিশ্বাসঘাতক (এয়াযীদ) কীভাবে ইমাম হুসাইন (রা:)-কে শহীদ করেছিল এবং কীভাবে সে মদীনা মোনাওয়ারাকে লণ্ডভণ্ড করে লুঠতরাজ চালিয়েছিল সে সম্পর্কে আলোকপাত করবো।

★ প্রথমতঃ আমরা মহানবী (দ:)-এর একটি সহীহ হাদীস পেশ করবো, যা মনোরম মদীনা মোনাওয়ারা নগরীকে যে সব লোক ’লণ্ডভণ্ড’ করে তাদের সম্পর্কে বর্ণনা দেয়।
ইমাম আহমদ (রহ:) হযরত সা’য়েব ইবনে খালেদ (রা:)-এর সূত্রে বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর হাদীস, যিনি এরশাদ ফরমান: “যে কেউ অন্যায়ের প্রসার এবং মদীনাবাসীদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে, তার প্রতি আল্লাহর লা’নত (অভিসম্পাত), ফেরেশতাকুলের এবং গোটা মানব জাতির (মো’মেন বান্দাদের) লা’নত-ও।”

[মুসনাদ-এ-ইমাম আহমদ হাম্বল; ইবনে কাসীর রচিত আল-বেদায়া ওয়ান্ নেহায়া গ্রন্থের ৮ম খণ্ডের ২৭৪ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃতি অনুযায়ী]

★ কুরআন মজীদে ঘোষিত হয়েছে: “নিশ্চয় যারা কষ্ট দেয় আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দ:)-কে, তাদের প্রতি আল্লাহর লা’নত (অভিসম্পাত) দুনিয়া ও আখেরাতে এবং আল্লাহ তাদের জন্যে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন।” [সূরা আহযাব, ৫৭ আয়াত]

মহানবী (দ:)-এর কাছে তাঁর দৌহিত্রকে নৃশংসভাবে শহীদ করা এবং তিনি যে স্থানকে হাররাম (পবিত্র) বলে ঘোষণা করেছেন ওকে তছনছ করার চেয়ে বেশি কষ্টদায়ক আর কী-ই বা হতে পারে?


১/ - এয়াযীদের নানা ঘৃণ্য অপরাধ :

ইবনে কাসীর ৬৩ হিজরীর (কারবালার) ঘটনা সম্পর্কে নিজ ’তারিখ’ গ্রন্থে লিখেন:
ইবনে যুবাইর (রা:) বলেন, ওহে মানুষেরা! তোমাদের আসহাবদেরকে হত্যা করা হয়েছে - ইন্না লিল্লাহে ইন্না ইলাইহে রাজেউন।
”এয়াযীদ একটি ঘৃণিত ভুল কাজ করেছে মদীনা মোনাওয়ারাকে তিন দিনের জন্যে ‘মোবাহ’ হিসেবে কার্যকর করার লক্ষ্যে মুসলিম ইবনে উকবাকে আদেশ দিয়ে। এটি ছিল তার সবচেয়ে বড় ও মারাত্মক ভুল। অনেক সাহাবা-এ-কেরাম ও তাঁদের সন্তানদের হত্যা করা হয়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদের মাধ্যমে এয়াযীদ আমাদের রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর দৌহিত্র ইমাম হুসাইন (রা:) ও তাঁর সাথীদের শহীদ করে; আর ওই তিন দিনে মদীনা মোনাওয়ারায় এমন সব গর্হিত অপরাধ সংঘটিত হয় যা আল্লাহ ছাড়া কেউই জানেন না। এয়াযীদ তার শাসনকে মুসলিম ইবনে উকবাহের প্রেরণের মাধ্যমে সংহত করতে চেয়েছিল, কিন্তু আল্লাহতা’লা তার ইচ্ছাকে পুরো হতে দেন নি এবং তাকে শাস্তি দিয়েছিলেন। বস্তুতঃ আল্লাহ তাকে মেরে ফেলেন যেমনিভাবে তিনি আগ্রাসী শহরগুলোকে নিজ কব্জায় নিয়েছিলেন; আর নিঃসন্দেহে আল্লাহর কব্জা কঠোর ও বেদনাদায়ক।” [আল-বেদায়া ওয়ান্ নেহায়া, ৮ম খণ্ড, ২৮৩ পৃষ্ঠা]

২/ - ইবনে যিয়াদও এয়াযীদের আচরণে বিরূপ

এয়াযীদের অপরাধ এতো গর্হিত ছিল যে এমন কি তার অনুগত উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদ যাকে মুসলিম ইবনে আকীল ও পরবর্তী পর্যায়ে ইমাম হুসাইনের হত্যার জন্যে পাঠানো হয়েছিল, এবং যাকে পত্র মারফত এয়াযীদ বলেছিল মক্কায় গিয়ে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা:)-এর ওপর অবরোধ দিতে, সেও তা করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছিল: ’আল্লাহর শপথ! আমি কোনো ফাসেক (পাপী এয়াযীদ)-এর খাতিরে দুটো (অপ)-কর্মতে জড়াবো না। আমি ইতোমধ্যেই রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর মেয়ের (ঘরের) নাতিকে হত্যা করেছি; আর এখন (সে নির্দেশ দিচ্ছে) বায়তুল হাররামের সাথে যুদ্ধ করতে।’ তবে এয়াযীদ যখন ইমাম হুসাইন (রা:)-কে শহীদ করে, তখন তার মা মারজানা তাকে বলেন, ‘তুমি মরো গে! তুমি এই জঘন্য অপরাধ কীভাবে করতে পারলে?’ তিনি তাকে অত্যন্ত কঠোর ভাষায় ভর্ৎসনা করেন। এয়াযীদকে জানানো হয় যে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা:) তাঁর বিভিন্ন ভাষণে এয়াযীদ সম্পর্কে বলতেন, সে একজন জালিয়াত, মদ্যপ, নামায তরককারী ও গায়িকা (ভ্রষ্টা) নারীদের সাহচর্যে অবস্থানকারী ব্যক্তি। [ইবনে কাসীর কৃত ‘আল-বেদায়া ওয়ান্ নেহায়া’, ৮ম খণ্ড, ২৭৯ পৃষ্ঠা]


ইবনে কাসীর আরও বর্ণনা করেন:
মুসলিম ইবনে উকবা, যার অপর পরিচিতি আস্ সাইফ মুসরাফ বিন উকবা নামে (আল্লাহ এই বদ ও মূর্খ লোকের কল্যাণ না করুন, আমীন), সে এয়াযীদের আদেশে মদীনা মোনাওয়ারার আক্রমণকে ‘বৈধতা’ দিয়েছিল তিন দিনের জন্যে। আল্লাহতা’লা এয়াযীদকে ‘জাযা’ ও ’খায়র’ মন্ঞ্জুর না করুন, আমীন। সে বহু ন্যায়বান মানুষের হত্যা সংঘটন করে এবং মদীনার বিপুল মালামাল লুঠপাট করে। একাধিক বর্ণনায় এসেছে যে সে ওখানে প্রচুর ক্ষতি সাধন করে এবং অনেক ফাসাদের জন্ম দেয়। এও উল্লেখিত হয়েছে যে (সাহাবী) হযরত মুয়াফল ইবনে সানান (রা:)-কে ইবনে উকবার সামনে বেঁধে রাখা হয় এবং তারপর শহীদ করা হয়। এই সময় সে বলে, ‘তুমি এয়াযীদের বন্ধু ছিলে, কিন্তু পরে তুমি তার বিরুদ্ধে কঠোর ভাষা ব্যবহার করেছ; তাই এয়াযীদ তোমার প্রতি বিরূপ ভাবাপন্ন হয়েছে। [আল-বেদায়াহ ওয়ান্ নেহায়াহ, ৮ম খণ্ড, ২৮০ পৃষ্ঠা]



৩/ - নেতৃস্থানীয় তাবেঈ সাঈদ ইবনে মুসাইয়েব (রহ:)-এর প্রতি এয়াযীদের বৈরিতা
আল-মুদাইনী (রহ:) বলেন যে হযরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়েব (রহ:)-কে নিয়ে আসা হয় মুসলিম বিন উকবার সামনে। সে তাঁকে তার কাছে বায়াত (আনুগত্য) গ্রহণ করতে বলে। তিনি এর জবাবে বলেন, “আমি (শুধু) সাইয়্যেদুনা হযরত আবু বকর (রা:) ও সাইয়্যেদুনা হযরত উমর (রা:)-এর সীরাতের (আদর্শের) প্রতি বায়াত নিতে পারি।” এমতাবস্থায় ইবনে উকবা তাঁকে হত্যার নির্দেশ দেয়। কিন্তু কেউ একজন (তাঁকে বাঁচাবার জন্যে) বলেন যে এই ব্যক্তি (হযরত সাঈদ) পাগল। এতে তাঁকে ছেড়ে দেয়া হয়। [ আল-বেদায়াহ ওয়ান্ নেহায়াহ, ৮ম খণ্ড, ২৮১ পৃষ্ঠা]


৪/ - শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী (রহ:) :-


ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী (রহ:) তাঁর রচিত ‘আল-এমতা’ বিল আরবাঈন’ শীর্ষক বইয়ের পুরো শিরোনামই দিয়েছেন ’এয়াযীদের প্রতি লা’নত’। ওতে তিনি লিখেন, “এয়াযীদকে ভক্তি ও তার প্রশংসা ’বেদআতী-গোমরাহ’ ব্যক্তি ছাড়া আর কেউই করে না, যার বিশ্বাস একেবারেই শূন্য। কেননা, এয়াযীদের এমন সব বৈশিষ্ট্য ছিল যার ভক্ত-অনুরক্ত হলে কুফর তথা অবিশ্বাসের যোগ্য হতে হয়। এটা এই কারণে যে আল্লাহর ওয়াস্তে ভালোবাসা এবং তাঁরই ওয়াস্তে ঘৃণা করা ঈমানেরই লক্ষ্মণ।” [দার আল-কুতুব আল-’এলমিয়্যা, বৈরুত, লেবানন হতে ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী প্রণীত ‘আল-’এমতা বিল্ আরবাঈন আল-মাতবাইনাত আস্ সামা’আ’ পুস্তকের ৯৬ পৃষ্ঠা]
ইমাম সাহেব (রহ:) অন্যত্র লিখেন, “এয়াহইয়া ইবনে আব্দিল মুলক্ বিন আবি গানিয়্যা যিনি ’সিকা (নির্ভরযোগ্য) বর্ণনাকারীদের একজন’, তিনি ‘সিকা’ বর্ণনাকারী নওফল বিন আবি আকরাব থেকে শুনেছেন: একবার খলীফা উমর ইবনে আবদিল আযীয (২য় উমর)-এর দরবারে মানুষেরা এয়াযীদ ইবনে মু’আবিয়া সম্পর্কে আলাপ করছিলেন। ওই সময় এক লোক এয়াযীদকে ‘আমীরুল মো’মেনীন’ (ঈমানদারদের শাসক) খেতাবে সম্বোধন করে। এটি শুনে খলীফা ২য় উমর (রাগান্বিত হয়ে) তাকে বলেন, “তুমি এয়াযীদকে আমীরুল মো’মেনীন ডেকেছ?” অতঃপর তিনি ওই লোককে ২০টি দোররা মারার হুকুম দেন। [ইমাম আসকালানী কৃত ‘তাহযিবুত্ তাহযিব’, ৬ষ্ঠ খণ্ডের ৩১৩ পৃষ্ঠা]


৫/ - ইমাম জালালউদ্দীন সৈয়ুতী (রহ:) ’তারিখুল খুলাফা’ গ্রন্থে যা বলেন -


”আপনি (ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু) শাহাদাত বরণ করেন এবং আপনার কর্তিত শির ইবনে যিয়াদের সামনে একটি থালায় করে আনা হয়। আপনাকে যে ব্যক্তি হত্যা করেছে তার ওপর আল্লাহর লা’নত (অভিসম্পাত); আরও লা’নত ইবনে যিয়াদ ও এয়াযীদের ওপর।” [ইমাম সৈয়ুতী রচিত ‘তারিখুল খুলাফা’ গ্রন্থের ১৬৫ পৃষ্ঠা]


ইমাম সৈয়ুতী (রহ:) আরও লিখেন: হযরত নওফল বিন আবি ফিরায়াত (রহ:) বলেছেন যে একবার তিনি খলীফা উমর ইবনে আব্দিল আযীযের দরবারে বসেছিলেন; এমন সময় এক লোক এয়াযীদকে ‘আমীরুল মো’মেনীন’ খেতাবে সম্বোধন করে। এতে খলীফা (রাগান্বিত হয়ে) তাকে বলেন, “তুমি এই ব্যক্তিকে ’আমীরুল মো’মেনীন’ বলো?” অতঃপর তিনি ওই লোককে ২০টি দোররা মারার আদেশ দেন। ৬৩ হিজরীতে এয়াযীদ জানতে পারে যে মদীনাবাসী মুসলমানবৃন্দ তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাই সে এক বিশাল সৈন্যবাহিনী পবিত্র নগরীতে প্রেরণ করে এবং মদীনাবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। পবিত্র নগরী লুঠপাটের পরে সে তার বাহিনীকে পবিত্র মক্কায় পাঠায় সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা:)-কে শহীদ করার জন্যে। ওই সময় ‘হোররা’-এর ঘটনা ঘটে। হোররায় কী ঘটেছিল আপনারা জানেন কি? এ প্রসঙ্গে (তাবেঈ) হযরত হাসসান বলেন, “মদীনা মোনাওয়ারায় হামলা হলে পর কেউই নিরাপদ ছিলেন না। অসংখ্য সাহাবী ও অন্যান্য মানুষ শহীদ হন এবং মদীনায় লুঠপাট হয়; আর সহস্র সহস্র কুমারী মেয়ের ইজ্জত নষ্ট করা হয়। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন। ... মহানবী (দ:) এরশাদ করেন: “মদীনাবাসীকে যে কেউ (সন্ত্রাসের মাধ্যমে) ভীত-সন্ত্রস্ত করলে আল্লাহ-ও তাকে অনুরূপ প্রতিদান দেবেন এবং তার ওপর আল্লাহর লা’নত, ফেরেশতাকুল ও মানব জাতির (মো’মেনদের) লা’নত-ও” (মুসলিম শরীফ)। মদীনাবাসী মুসলমানবৃন্দ যে কারণে এয়াযীদের বায়াত গ্রহণ করেন নি, তা হলো সে ’অত্যধিক পাপাচারে লিপ্ত’ ছিল। আল-ওয়াকিদী সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ বিন খাযলাতাল গুসাইল (রা:) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: “আল্লাহর শপথ! আমরা এয়াযীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছি যখন আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে ‘আমাদের প্রতি আসমান থেকে পাথর নিক্ষেপ করা হবে’; কেননা, এয়াযীদী গোষ্ঠী তাদের মা, বোন ও কন্যাদের বিয়ে করা আরম্ভ করেছিল, প্রকাশ্যে মদ্যপান করছিল এবং নামাযও তরক করছিল।” ইমাম যাহাবী বলেন, এয়াযীদ ‘মদ্যপান ও অন্যান্য কুকর্মে লিপ্ত’ হবার পর মদীনাবাসীদের প্রতি জুলুম-নিপীড়ন করলে মক্কাবাসী মুসলমানবৃন্দও চারদিক থেকে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। আল্লাহতা’লা এয়াযীদের জীবনে কোনো রহমত-বরকত দেন নি। (এয়াযীদ মক্কা আক্রমণ করে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহুকেও শহীদ করে)। [ইমাম  সৈয়ুতী প্রণীত ‘তারিখুল খুলাফা’ গ্রন্থের ১৬৭ পৃষ্ঠা]



৬/ - আল্লামা মাহমূদ আলূসী তাঁর কৃত ‘তাফসীরে রূহুল মা’আনী’ কেতাবে সূরা মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর ২২-২৩ নং আয়াতগুলোর ব্যাখ্যায় বলেন: “এয়াযীদের প্রতি ‘লা’নত’ দেয়ার দালিলিক প্রমাণ এই আয়াত থেকেই বের করা হয়েছে, যেমনটি ইমাম আহমদ (রহ:)-এর সূত্রে উল্লেখ করেছেন আল-বরযানজি (রহ:) নিজ ‘আল-আশআত’ পুস্তকে এবং আল-হায়তামী তাঁর ‘আস্ সাওয়াইক্ক’ গ্রন্থে এই মর্মে যে, ইমাম আহমদ (দ:)-এর পুত্র আবদুল্লাহ তাঁকে এয়াযীদের প্রতি লা’নত দেয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেন। ইমাম সাহেব বলেন, ‘তার প্রতি লা’নত দেয়া যাবে না কেন, যেখানে স্বয়ং আল্লাহতা’লা-ই কুরআন মজীদে তাকে লা’নত দিয়েছেন?’ আবদুল্লাহ আবার প্রশ্ন করেন, ‘কিতাবুল্লাহর ওই আয়াতটি তেলাওয়াত করুন যাতে আমি জানতে পারি কীভাবে এয়াযীদের প্রতি লা’নত দেয়া হলো?’ এমতাবস্থায় ইমাম আহমদ (রহ:) নিম্নবর্ণিত আয়াতগুলো তেলাওয়াত করেন, ‘তবে কি তোমোদের এ লক্ষণ দৃষ্টিগোচর হচ্ছে যে তোমরা শাসনক্ষমতা লাভ করলে পৃথিবীতে বিপর্যয় ডেকে আনবে এবং আপন আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে? এরা হচ্ছে ওই সব লোক যাদের প্রতি আল্লাহতা’লা অভিসম্পাত (লা’নত) দিয়েছেন...’ (আল-কুরআন, ৪৭:২২-২৩)। অতঃপর তিনি বলেন, ‘এয়াযীদ যা করেছে তার থেকে বড় বিপর্যয় আর কী হতে পারে’?” [আল্লামা আলূসী কৃত ’তাফসীরে রূহুল মা’আনী’ গ্রন্থের ৯ম খণ্ড, আল-কুরআন ৪৭:২২-২৩-এর ব্যাখ্যায়]
দ্বিতীয়তঃ আল্লামা আলূসী আরও বলেন, “আর আমি বলি, আমার ভাবনায় যা প্রাধান্য পায় তা হলো এই খবীস (এয়াযীদ) মহানবী (দ:)-এর রেসালতের পক্ষে সাক্ষ্য দেয় নি। আমার মতে, এয়াযীদের মতো লোককে লা’নত দেয়া সঠিক, যদিও তার মতো এতো বড় ফাসিকের কথা কল্পনা করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়; আর এটাও স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে সে কখনোই তওবা করে নি; (উপরন্তু) তার তওবা করার সম্ভাবনাও তার ঈমান পোষণ করার সম্ভাবনার চেয়ে ক্ষীণতর। এয়াযীদের পাশাপাশি ইবনে যিয়াদ, ইবনে সা’আদ ও তার দল-বল এতে জড়িত। অবশ্যঅবশ্য কেয়ামত দিবস অবধি এবং ইমাম হুসাইন (রা:)-এর জন্যে (মো’মেনদের) চোখের পানি যতোদিন ঝরবে ততোদিন পর্যন্ত আল্লাহর লা’নত তাদের সবার ওপর পতিত হোক; তাদের বন্ধু-বান্ধব, সমর্থক, দল-বল এবং ভক্তদের ওপরও পতিত হোক!” [তাফসীরে রূহুল মা’আনী, ২৬তম খণ্ড, ৭৩ পৃষ্ঠা]


৭/ - ইমাম যাহাবীর ভাষ্য -


”এয়াযীদ ছিল এক জঘন্য নসিবী (আহলে বায়তকে ঘৃণাকারী)। সে রাজত্ব আরম্ভ করে ইমাম হুসাইন (রা:)-কে শহীদ করে এবং রাজত্বের ইতি টানে হাররা-এর ঘটনা দ্বারা (অর্থাৎ, মদীনা অবরোধ, যার দরুন সহীহ হাদীস মোতাবেক সে লা’নতের যোগ্য হয়)। ফলে মানুষেরা তাকে ঘৃণা করতো; অধিকন্তু সে জীবনে রহমত-বরকত কিছুই পায় নি; ইমাম হুসাইন (রা:)-এর শাহাদাতের পরে তার বিরুদ্ধে অনেকে অস্ত্র তুলে নেন - যেমনটি করেছিলেন মদীনাবাসীগণ, যাঁরা আল্লাহর ওয়াস্তে (তার বিরুদ্ধে) রুখে দাঁড়ান।” [‘সিয়্যার আল-আ’লম আন্ নুবালা’, ৪র্থ খণ্ড, ৩৭-৩৮ পৃষ্ঠা]


দ্বিতীয়তঃ ইমাম যাহাবী আরও লিখেন, “আমি বলি, এয়াযীদ মদীনাবাসীদের সাথে যে আচরণ করেছিল, এবং ইমাম হুসাইন (রা:) ও তাঁর বংশধরদের যেভাবে হত্যা করেছিল, আর যেভাবে মদ্যপান ও গর্হিত কাজে লিপ্ত হয়েছিল, তাতে মানুষেরা তাকে ঘৃণা করতেন এবং তার বিরুদ্ধে একাধিকবার রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। আল্লাহতা’লা এয়াযীদের জীবনে রহমত-বরকত দেন নি; উপরন্তু, আবু বিলাল মিরদাস্ বিন আদইয়া আল-হানযালী তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।” [তারিখুল ইসলাম ওয়া তাবাকাত আল-মাশাহির ওয়াল্ আ’লম, ০০৫ খণ্ড,৩০ পৃষ্ঠা]


তৃতীয়তঃ ইমাম যাহাবী আরও লিখেন, “যিয়াদ হারসী বর্ণনা করে: ‘এয়াযীদ আমাকে মদ পান করতে দেয়। আমি ইতিপূর্বে কখনোই এ রকম মদ পান করি নি; তাই তাকে জিজ্ঞেস করি কোথা থেকে সে এই মদের উপাদান সংগ্রহ করেছে। এয়াযীদ জবাবে বলে, এটি মিষ্টি ডালিম, ইসপাহানের মধু, হাওয়াযের চিনি, তায়েফের আঙ্গুর ও বুরদাহ-এর পানি দ্বারা প্রস্তুতকৃত।’ আহমদ ইবনে মাসামা বর্ণনা করেন: ‘একবার এয়াযীদ মদ্যপান করে নাচা আরম্ভ করে; হঠাৎ সে পড়ে যায় এবং তার নাক দিয়ে রক্ত বেরুতে আরম্ভ করে’।” [সিয়ার আল-আ’লম আন্ নুবালাহ, ০০৪ খণ্ড, ০৩৭ পৃষ্ঠা]



৮/ - এয়াযীদ সম্পর্কে কাজী সানাউল্লাহ পানিপথী (রহ:)-এর ভাষ্য -


মহান মুফাসসির ও সুবিখ্যাত গ্রন্থাবলীর প্রণেতা এবং সকল সুন্নী মুসলমানের কাছে গ্রহণযোগ্য ইসলামী জ্ঞান বিশারদ কাজী সানাউল্লাহ পানিপথী (রহ:) কুরআন মজীদের ১৪:২৮ আয়াতখানি উদ্ধৃত করেন: “আপনি কি তাদেরকে দেখেন নি যারা অকৃজ্ঞতাবশত আল্লাহর অনুগ্রহকে বদল করেছে এবং আপন সম্প্রদায়কে ধ্বংসের ঘরে নামিয়ে এনেছে?” অতঃপর এর তাফসীরে হযরত পানিপথী (রহ:) লিখেন, “বনী উমাইয়া সব সময় কুফরীর ওপর উল্লাস প্রকাশ করেছিল; তবে আবু সুফিয়ান, আমীরে মোয়াবিয়া (রা:), আমর ইবনে আস্ এবং অন্যান্যরা মুসলমান হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে এয়াযীদ ও তার সাথীরা আল্লাহর এই নেয়ামত (আশীর্বাদ) প্রত্যাখ্যান করে আহলে বায়তের প্রতি বৈরিতার পতাকা উড়ায়; আর শেষমেশ ইমাম হুসাইন (রা:)-কে শহীদ করে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায়, যেখানে সে মহানবী (দ:)-এর ধর্মকে অস্বীকার করে বসে। ইমাম হুসাইন (রা:)-এর শাহাদাতের পরে সে বলে: ‘আমার পূর্বপরুষেরা বেঁচে থাকলে তাঁরা আজ দেখতেন কীভাবে আমি মহানবী (দ:)-এর পরিবার ও বনী হাশেমের ওপর প্রতিশোধ নিয়েছি।’ সে এ কথা ব্যক্ত করতে যে দ্বিচরণ শ্লোক ব্যবহার করে তার শেষাংশে আছে - ’বদরের যুদ্ধে আহমদ (মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) আমার পূর্বপুরুষদের সাথে যা কিছু করেছেন, তার বদলা আমি নেবো’ (নাউযুবিল্লাহ)। সে মদ হালাল ঘোষণা করে এবং এর প্রশংসায় বলে, ‘যদি মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর ধর্মে মদ হারাম হয়, তাহলে ঈসা ইবনে মরঈয়মের (আ:) ধর্মে একে জায়েয জেনো’।” [তাফসীরে মাযহারী, ৫ম খণ্ড, ২১১-২১২ পৃষ্ঠা]



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন